বাংলা সাহিত্যে মুনীর চৌধুরীর লেখা একটা অমর উক্তি আছে, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়। এই অলঙ্ঘনীয় সত্যটা মুনীর চৌধুরীর আগে এত গুছিয়ে ও শক্ত করে কেউ বলেনি বা বলতে পারেনি। যার বাস্তব চিত্র কালের আবর্তেও অপরিবর্তিত থেকে যাবে যুগের পর যুগ। এটা ইতিহাস। মানুষ বদলালেও ইতিহাস কিন্তু বদলায় না।
বহুকাল ধরে সত্যটা বহন করে চলে ইতিহাস নামের এই যাত্রীটি। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। ৮ মার্চ এমনি এক ইতিহাস হয়ে বেঁচে আছে সময়ের স্রোতে।
নারী দিবস নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও আলাপ আলোচনা এবং উৎসাহের কমতি নেই। কিন্তু এর পিছনের দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষার ইতিহাসটা আমরা হয়তো জানি না। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ঘটনার শুরু ১৮৫৭ সালে।
৮মার্চ মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে আবার ১৯০৮ সালে শ্রমজীবী নারীরা নিউইয়র্কের পথে নেমেছিলেন। ১৯০৯ সালে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব দেন একটি দিন হোক নারীদের অধিকার আদায়ের দিন। অতঃপর ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে।
এখন মোদ্দা কথায় আসা যাক। অধিকার ও ক্ষমতায়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান কোথায়? পরিসংখ্যান বলে, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে তাঁদের নেতৃত্বের সুযোগ। কিন্তু সেটি আরও বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। দেশে এখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা হচ্ছে। দেশের অনেক মানুষই এখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক সচেতন। তবে এত কিছুর মধ্যেও বাস্তবতাটা কিন্তু ভিন্ন।
কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় নারীরা বঞ্চিত হন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় না। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নারীবান্ধব নয়। এর পেছনে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। এসব কারণে অনেক সক্ষম নারী কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করেন না। এ জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন।
তবে এর মধ্যেও কিছু আশার বিষয় আছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা অনেক এগিয়ে রয়েছেন। গত ১২তম সাফ গেমস সেটা প্রমাণ করে। সেখানে বাংলাদেশ ৭৫টি পদক অর্জন করে। এর ৩৯টি পদকই নারীরা জিতেছেন।
দেশে নারী উদ্যোক্তা, পরিচালক আগের চেয়ে বেড়েছে উল্ল্যেখযোগ্য মাত্রায়। এই জোয়ারকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন জোয়ারের অনুকূলে বাতাস। আর সেই বাতাস হতে হবে পুরুষদেরই। এক হাতে যেমন তালি বাজে না, তেমনি আমরা যতই নারীর ক্ষমতায়ন বলে গলা ফাটাই না কেন, নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক না হলে নারীর স্বাধীনতা আসা সম্ভব না। এই নারী দিবসে এটাই হোক আমাদের একমাত্র মূলমন্ত্র।
এখনই ভাবার সময়। সময় এসেছে সব বাধা বিপত্তি পিছনে ফেলে দুর্বার গতিতে শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার। যেই দুর্বার গতির কাছে হার মানবে সব গ্লানি, সব কালিমা। বায়োজিন আছে আপনাদের সাথে। জয় হোক নারীর। জয় হোক সৌন্দর্যের। সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
Facebook Comments