যাদের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম তাদেরকে আন্ডারওয়েট বলা হয়। ১৮.৫ এর কম BMI(
Body Mass Index) হলে তাকে আন্ডারওয়েট ধরা হয়। আন্ডারওয়েট ব্যক্তির শরীর স্বাস্থ্যকর হাড়, ত্বক ও চুল তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় নাহ। ওভারওয়েট ব্যক্তিদের মতো আন্ডারওয়েট ব্যক্তিদেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।
🍁 আন্ডারওয়েটের কারণ
আন্ডারওয়েটের অনেক গুলো কারণ রয়েছে। আবার অনেকক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ একসাথে কাজ করে থাকে। কারণ গুলো জেনে নেয়া যাক।
হাই বডি মেটাবলিজম - অনেককেই বলতে শোনা যায় "অনেক খাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই ওয়েট বাড়ছেনা"। এটা সাধারণত হাই বডি মেটাবলিজম এর কারণে হয়ে থাকে। বেশী ক্যালরী গ্রহণ করার পরেও এমন অবস্থায় ওজন বৃদ্ধি পায়না।
শারীরিক অসুস্থতা এবং ক্রনিক ডিজিজ- কিছু কিছু অসুস্থতা রয়েছে যার কারণে ডায়রিয়া, বমি বা বমি বমি ভাব হয় যার ফলে ওজন বৃদ্ধি ব্যহত হয়। আবার কিছু রোগ আছে যা ক্ষুধামন্দা তৈরী করে যেমন - ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, থাইরয়েড, পরিপাকের সমস্যা ইত্যাদি।
বংশগত - বংশগত কারণেও আন্ডারওয়েট হয়ে থাকে।
মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম - প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরী খরচ করে ফেলে যার কারণে ওজন কমে যেতে পারে।
মানসিক অসুস্থতা - ডিপ্রেশন, স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, OCD( Obsessive-Compulsive Disorder) এর কারণে ক্ষুধামন্দার সৃষ্টি হয় যার ফলে ওজন হ্রাস পায়। আবার ইটিং ডিজঅর্ডার যেমন -
Anorexia Nervosa এর কারণে ওজন হ্রাস পায়।
হাইপারথাইরয়েডিজম - থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন নির্গত হওয়াকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। এই হরমোন আমাদের শরীর কতটুকু শক্তি খরচ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণে ক্যালরী খরচের মাত্রাও বৃদ্ধি পায় যার ফলে দ্রুত ওজন হ্রাস পায়।
🍁 আন্ডারওয়েট বা ক্ষীণওজনের ক্ষতিকর দিক
অনেকে মনে করে থাকেন শুধুমাত্র ওভারওয়েটের কারণেই হয়তো রোগ হয়! ব্যাপারটা আসলে সম্পূর্ণ সত্য না। আন্ডারওয়েট ব্যক্তিরও বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাছাড়া আন্ডারওয়েট ব্যক্তির স্বাভাবিক ভাবেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় সে ঘনঘন অসুস্থতার শিকার হন। আন্ডারওয়েটের ক্ষতিকর দিকগুলা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অপুষ্টি - আন্ডারওয়েট ব্যক্তি পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহন করেনা যা শরীরের দরকার হয়ে থাকে। যে কারণে সহজেই অপুষ্টির সৃষ্টি হয়। অপুষ্টির কারণে সবসময় ক্লান্ত লাগা, দূর্বলতা, কাজের প্রতি অনীহা, তুলনামূলক রোগে বেশী আক্রান্ত হওয়া অথবা সুস্থ হতে দেরী হয়। এছাড়াও চুল পড়ে যাওয়া, পাতলা হয়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, দাঁতের সমস্যাও অপুষ্টির কারণে হয়ে থাকে।
শিশুর মস্তিস্ক গঠণ - সাধারণত ৩বছর পর্যন্ত শিশুদের মস্তিস্ক খুব দ্রুত গঠন হয়। এজন্য শিশুর সঠিক পুষ্টির দরকার হয়। আন্ডারওয়েট শিশুর ক্ষেত্রে মস্তিস্ক গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়না তাই মস্তিস্ক গঠনে বিঘ্ন ঘটে।
অস্টিওপোরোসিস - কম ওজন অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যারা অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হয় তাদের অধিকাংশই আন্ডারওয়েট।
রক্তশূন্যতা - শরীরে রক্ত উৎপন্ন হওয়ার জন্য পরিমাণমত আয়রনের দরকার হয়। আন্ডারওয়েট ব্যক্তিদের শরীরে সঠিক পরিমাণ ভিটামিন এবং মিনারেল সাপ্লাই থাকেনা বিধায় তাদের মাঝে এনিমিয়াও দেখা যায়। এনিমিয়ার কারণে মাথা ঘুরানো, ক্লান্তি এবং মাথাব্যথা হয়ে থাকে। সিভিয়ার এনিমিয়া মৃত্যুও ঘটায়।
অনিয়মিত মেন্সট্রুয়াল সাইকেল - আন্ডারওয়েট নারীদের মাসিক অনিয়মিত হয় যার ফলে ইনফার্টিলিটির সৃষ্টি হয়।
গর্ভাবস্থা - যেসব নারীরা গর্ভাবস্থায় আন্ডারওয়েট থাকেন তাদের প্রিম্যাচিউরড শিশু অর্থাৎ ৩৭ সপ্তাহের আগেই শিশু জন্ম দেয়ার সম্ভবনা থাকে। যার ফলে শিশুও অপুষ্টির শিকার হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া - শরীর বৃদ্ধি এবং সুস্থ হাড় গঠনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান দরকার হয়। আন্ডারওয়েট ব্যক্তির শরীর এই পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে পারেনা যার ফলে বৃদ্ধি ব্যহত হয়ে থাকে।
🍁 আন্ডারওয়েট থেকে পরিত্রাণের উপায়
অনেক অনলাইন প্লাটফর্মে প্রায়শই এমন কিছু পোস্ট দেখা যায় যে "আমার ওজন অনেক কম, কিভাবে ওজন বাড়াবো?" তার উত্তরে বেশীর ভাগ মানুষই অস্বাস্থ্যকর উপায় যেমন - বেশী পরিমাণ জাংক ফুড বা রেস্টুরেন্ট এর খাবার, কোল্ড ড্রিংক্স ইত্যাদি খাওয়ার কথা বলে থাকে। এসব খাবার বেশী খাওয়া যেমন অস্বাস্থ্যকর তেমনি পরবর্তীতে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজ আমরা স্বাস্থ্যকর উপায়ে কিভাবে ওজন বৃদ্ধি করা যায় তা জানবো।
প্রোটিন - ওজন বৃদ্ধির জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ খাবার হচ্ছে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন - ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, ডাল, বাদাম ইত্যাদি। তবে কেউ যদি কিডনি পেশেন্ট হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে তাকে পরিমাণমতো প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
ক্যালরি গ্রহণ - আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ক্যালরি চাহিদা রয়েছে। ওজন বৃদ্ধি করতে চাইলে অবশ্যই ক্যালরি চাহিদা থেকে আরো ৩০০-৫০০ ক্যালরি বেশী গ্রহণ করতে হবে।
কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট - ওজন কমাতে চাইলে অনেকে কার্ব ও ফ্যাট বাদ দিয়ে দেয়। ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই কার্ব এবং ফ্যাট খুব ভাল কাজ করে। যদি ওজন বৃদ্ধিই কারো একমাত্র লক্ষ্য হয় তবে প্রোটিনের সাথে সাথে অধিক পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাট গ্রহণ করতে হবে।
এনার্জি-ডেন্স ফুড - যেসব খাবার অল্প পরিমাণ খেলে অধিক শক্তি উৎপন্ন হয় সেসব খাদ্যকে এনার্জি-ডেন্স ফুড বলে। যেমন - কাঠবাদাম, চীনাবাদাম,
খেজুর, দুধ, দই, চিজ, আলু,কলা, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি।
পানি - প্রতিদিন ২-২.৫ লিটার পানি গ্রহণ করতে হবে। অনেকের খাবারের আগে পানি খাওয়ার অভ্যাস আছে কিন্তু এর ফলে পেট ভরা থাকে এবং বেশী খাবার গ্রহণ করা যায়না। খাবার খাওয়ার ১৫মিনিট পর পানি গ্রহণ করতে হবে।
খাবার গ্রহণের ধারাবাহিকতা - খাবার গ্রহণের সময় প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রথমে গ্রহণ করা এবং সবজি খাবারের শেষে গ্রহণ করতে হবে।
প্লেটের আকৃতি - বড় প্লেটে খাদ্য গ্রহণ করলে সাধারণত বেশী ক্যালরি গ্রহণ করা যায়।
মিল - সারাদিনের মিলকে ৫ ভাগে ভাগ করে নিলে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। একবারে বেশী না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খেলে ওজন বৃদ্ধিতে সফলতা পাওয়া যায়।
ক্যাফেইন - ক্যাফেইন জাতীয় খাবার যেমন - চা, কফি,
সোডা ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য অরুচির সৃষ্টি করে যা আন্ডারওয়েটের কারণ।
এক্সারসাইজ - সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন ৩০মিনিট হাঁটা বা ১৫মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা যেতে পারে।
মশলা - যাদের এসিডিটির সমস্যা নেই তারা খাবারে মশলা যেমন - গোলমরিচ, আদা, রসুন, এলাচি যুক্ত করে খাবারকে সুস্বাদু করতে পারেন। যা খাবারে রুচি আনবে। এছাড়া ভিনেগার, লেবুর রস বা আচার খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।
রুচিবর্ধক - লেবু, কমলা লেবু, আমলকী ইত্যাদি ফল খাবারের রুচি বৃদ্ধি করে।
নিউট্রিশন সায়েন্সে অপুষ্টির দুষ্টুচক্র বলে একটা কথা আছে। একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কাজ করার ক্ষমতা কম হয় যার ফলে সে কম আয় করে এবং এই কম আয়ের জন্য সে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারেনা যার ফলে সে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে।
এজন্য সবার উচিৎ খাদ্যগ্রহণ এর ব্যাপারে সচেতন হওয়া।
Writer:
Kazi Sumaiya Bani
Fitness Nutritionist