Help line 01755-660522

Search
অকালে চুল পাকা ঠেকান: সায়েন্টিফিক উপায় ও প্রাকৃতিক যত্ন

চুল পাকা (Premature Graying of Hair) সাধারণত বয়স বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক লক্ষণ। তবে অনেকেরই বয়স ত্রিশের নিচে থাকতেই চুল পেকে যেতে দেখা যায়। বংশগত কারণ ছাড়াও খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত জীবনযাপন, পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব, মানসিক চাপ—এসব কারণ চুল পাকার হার বাড়িয়ে দেয়। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী, চুল পাকা প্রতিরোধ করতে গেলে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন রুটিনে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীভাবে এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, সে বিষয়েই এখানে আলোচনা করা হলো।

১. চুল পাকার বৈজ্ঞানিক কারণ

চুলের প্রাকৃতিক রং নির্ভর করে মেলানিন (Melanin) নামক এক ধরনের প্রাকৃতিক রঙ বা পিগমেন্ট উপর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বা কিছু ক্ষেত্রে অকালে মেলানিন উৎপাদন কমে গেলে চুল সাদা বা ধূসর হয়ে যেতে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী হওয়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (Oxidative Stress), ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি এবং জিনগত (Genetic) বিষয়গুলি চুল পাকার প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে পারে।

২. খাদ্যাভ্যাস: পুষ্টিকর খাবার ও পরিমিত পরিমাণ

বাংলাদেশের খাবারের স্বাদ, বৈচিত্র্য ও প্রাপ্যতা ভিন্নতর হলেও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা ততটা কঠিন নয়। চুল পাকা প্রতিরোধে নিম্নোক্ত পুষ্টি উপাদানসমূহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:

প্রোটিন

চুল মূলত কেরাটিন (Keratin) নামক প্রোটিন দিয়ে গঠিত। ডাল, ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, দুধ ও দই খেলে পর্যাপ্ত প্রোটিন পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স (বিশেষ করে ভিটামিন B12, B7, B6)

১. এই ভিটামিনগুলোর অভাবে চুল পাকার হার বেড়ে যেতে পারে।
২. ডিম, দুধ, পনির, লিভার, ডাল, শস্যদানা ইত্যাদি খাবার থেকে সহজে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ও বায়োটিন পাওয়া যায়।

ভিটামিন ডি ও ভিটামিন ই

১.  ভিটামিন ডি সূর্যালোক ও কিছু খাবার (যেমন– ডিমের কুসুম, সামুদ্রিক মাছ) থেকে পাওয়া যায়।
২. ভিটামিন ই ফল, বাদাম ও বীজজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে থাকে; চুলের কোষগুলোকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

আয়রন (Iron) ও দস্তা (Zinc)

আয়রনের অভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে চুলের গোড়ায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। পালংশাক, কচুশাক, মাংস ও ডালসহ বিভিন্ন শাকসবজি ও প্রাণিজ উৎস থেকে আয়রন পাওয়া যায়।
দস্তা (Zinc) সমৃদ্ধ খাবার যেমন মসুর ডাল, মিষ্টি কুমড়ার বিচি,বাদাম, ডিম ইত্যাদি চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার

অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানোর জন্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে সহজলভ্য মৌসুমি ফল যেমন আম, জলপাই, আমলকি, পেয়ারা এবং শাকসবজি (লালশাক, পালংশাক, বেগুন) শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বাড়ায়।

৩. লাইফস্টাইলে পরিবর্তন: ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ

নিয়মিত ব্যায়াম

সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন ৩০ মিনিট করে হালকা ব্যায়াম বা দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং বা যোগব্যায়াম করলে শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। এতে চুলের গোড়া পর্যন্ত পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছানো সহজ হয়, যা মেলানিন উৎপাদনে সহায়ক।

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম

পর্যাপ্ত ও গুণগত মানসম্মত ঘুম হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে। নিয়মিত ঘুমের অভাবে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, যা অকালে চুল পাকার একটি বড় কারণ হতে পারে।

মানসিক চাপ কমানো

১. দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ (Chronic Stress) কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়, যা চুল পাকার একটি অন্যতম কারণ।
২. মেডিটেশন, বইপড়া, প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া, অথবা যে কোনো ইতিবাচক বিনোদনমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে মানসিক চাপ কমানো সম্ভব।

৪. দেশীয় প্রাকৃতিক যত্ন

আমলকির রস বা তেল

আমলকি ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণে ভরপুর। চুলে আমলকির তেল ব্যবহার বা আমলকির রস পান করাও চুলের স্বাস্থ্যে উপকারী বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

নারকেল তেল ও মেথি বীজ

নারকেল তেল বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই ব্যবহার হয়। নারকেল তেলে মেথি বীজ ফুটিয়ে ছেঁকে মাথার ত্বকে হালকা করে ম্যাসাজ করলে চুলের গোড়া মজবুত হয় বলে অনেকে দাবি করেন। পরিমিত ব্যবহারে উপকারী হলেও অতিরিক্ত তেল ব্যবহার চুলকে ঘনিষ্ঠভাবে ময়লা আকর্ষণ করতে পারে। তাই নিয়মিত শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

৫. অতিরিক্ত রাসায়নিক পণ্য ও হিটস্টাইল থেকে দূরে থাকা

কেমিক্যালযুক্ত হেয়ার ডাই ও স্টাইলিং পণ্য

অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদানযুক্ত হেয়ার ডাই, ব্লিচ, হেয়ার স্প্রে বা জেল ব্যবহার চুলের গঠন নষ্ট করতে পারে। ফলে অকালে চুল পাকার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

হিট স্টাইলিং

হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার বা কার্লিং আয়রন দিয়ে অতিরিক্ত তাপ প্রয়োগ করলে চুলের কেরাটিন প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। এতে চুল দুর্বল হয় এবং অকালপক্বতার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

৬.  সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা করুন

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV Rays) সরাসরি চুলের ক্ষতি করে। এই রশ্মি ফলে ফ্রি র‍্যাডিকেল তৈরি করে যা চুলে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে মেলানিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে চুলের প্রাকৃতিক কালো রঙ হারিয়ে ধীরে ধীরে ধূসর বা সাদা হয়ে যেতে শুরু করে। োতাই সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে চুলকে রক্ষা করা খুবই জরুরি।

৭. চিকিৎসা পরামর্শ ও পরীক্ষা

যদি খুব দ্রুতগতিতে চুল পাকতে থাকে, তবে রক্তে ভিটামিন ও খনিজের মাত্রা (যেমন B12, আয়রন ইত্যাদি) পরীক্ষা করে দেখা দরকার। হরমোনজনিত বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণেও চুল পেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়াই শ্রেয়।

চুল পাকা প্রতিরোধের জন্য সম্পূর্ণ “ম্যাজিক” কোনো উপায় নেই। তবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখলে চুল পাকা অনেকটাই ঠেকিয়ে রাখা যায়। বাংলাদেশের খাবার, ফলমূল ও সহজলভ্য প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর যথাযথ ব্যবহার এবং সুস্থ রুটিন মেনে চললে চুল থাকবে সুন্দর ও তারুণ্যদীপ্ত। নিজের শরীর ও মনের যত্ন নিলে চুলের যত্নের বড় অংশটাই হয়ে যায়। নিয়ম মেনে দীর্ঘমেয়াদে দেখবেন, চুলের উজ্জ্বলতা ও রং ধরে রাখা আর বড় কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *